বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে হালাল পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্ভাবনাময় বাজারে প্রবেশে কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
গালফ অঞ্চলের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রায় ১ কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করছেন, যারা হালাল পণ্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাব্য ভোক্তা।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ বলছেন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ভারত ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক হালাল বাজারে বড় সফলতা পেয়েছে।
উপলব্ধ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক হালাল পণ্যের বাজারের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৭.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ১০ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বাজারে খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, প্রসাধনী, পর্যটনসহ নানা খাতে মুসলিম জনসংখ্যা, ব্যয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নৈতিক ও টেকসই পণ্যের চাহিদা বাড়ার ফলে দ্রুত বিস্তার ঘটছে।
বিশ্বে প্রায় ১.৯ বিলিয়ন মুসলিম বসবাস করছেন, যা বৈশ্বিক জনসংখ্যার ২৫%। ২০৫০ সালের মধ্যে এটি ২.৭৬ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। শুধুমাত্র হালাল খাদ্য ও পানীয় খাতের মূল্য ২০২৪ সালে ২.৭১ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৪.৫৬৯ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সম্ভাব্য এই বাজার ধরতে সরকার ইতোমধ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ বাংলাদেশকে তাদের পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়ায় হালাল মান বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
এ লক্ষ্যে, ইসলামী ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে সৌদি অ্যাক্রেডিটেশন সেন্টারের (SAAC) তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ৯-১২ জুলাই, ২০২৫ বাংলাদেশ সফর করে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন এমাদ ওসামা এইচ ওওয়াইদা (অ্যাক্রেডিটেশন ম্যানেজার), মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এম আল-আরিফি (টেকনিক্যাল অ্যাসেসর), এবং রাকান আল খলিফা (ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স এক্সপার্ট)।
প্রতিনিধি দল ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটির সাথে বৈঠক করেছে।
বেঙ্গল মিটের হেড অব সাপ্লাই চেইন অ্যান্ড এক্সপোর্ট একেএম সাইদুল হক ভূঁইয়া জানান, প্রতিনিধি দল পাবনায় বেঙ্গল মিটের কারখানা পরিদর্শন করেছে এবং পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
তিনি আরও জানান, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার বাজারে প্রবেশে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের SMIC, SFDA এবং মালয়েশিয়ার JAKIM এর অনুমোদন প্রয়োজন।
ইসলামী ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর (হালাল সার্টিফিকেশন বিভাগ) ড. মো. আবু সালেহ পাটোয়ারী জানান, সৌদি প্রতিনিধি দলের সফরের ব্যয় বাংলাদেশ সরকার বহন করেছে।
শিল্প সচিব মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, “শুধু মুসলমানরাই নয়, বরং অমুসলিমরাও স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার কারণে হালাল পণ্যে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।”
তিনি জানান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং তুরস্ক হালাল পণ্যের বৃহত্তম ভোক্তা দেশ, এবং ইউরোপেও এর চাহিদা বাড়ছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (BCI)-এর উদ্যোগে আয়োজিত ‘হালাল বাজার, উৎপাদন পদ্ধতি ও সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া’ বিষয়ক এক কর্মশালায় তিনি এসব কথা বলেন।
এতে BCI সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ), BSTI-এর ডেপুটি ডিরেক্টর খালিদ আবু নাসের, সহকারী পরিচালক রেবেকা সুলতানা এবং বিসিআই সেক্রেটারি জেনারেল ড. হেলাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি কৌশলগত পরিকল্পনা, মানসম্পন্ন উৎপাদন এবং কার্যকর বিপণনে মনোযোগ দেয়, তাহলে হালাল পণ্যের $৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অবস্থানকারী কয়েক মিলিয়ন বাংলাদেশি এই হালাল পণ্যের প্রধান ভোক্তা।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্রাণ এক্সপোর্টস লিমিটেড ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে।
কিন্তু সৌদি সরকার বাংলাদেশকে একটি পূর্ণাঙ্গ স্ট্যান্ডার্ড প্রক্রিয়া অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছে, তা না হলে বাজার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া যৌথভাবে হালাল পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ এবং হালাল ইকোসিস্টেম উন্নয়নে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর, ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মালয়েশিয়ার সেরুনাই প্রতিনিধি দল ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে ইসলামী ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম সভার উদ্বোধন করেন এবং “রিভার্স লিংকেজ প্রকল্প” নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
উল্লেখ্য, এই প্রকল্প মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে জ্ঞান, প্রযুক্তি ও দক্ষতা বিনিময়ের মাধ্যমে হালাল ইকোসিস্টেমকে সমৃদ্ধ করবে এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।