বাংলাদেশ ও পাকিস্তান জনগণের পারস্পরিক কল্যাণের জন্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। রবিবার (২৪ আগস্ট ২০২৫) সকালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিনেটর মোহাম্মদ ইশাক দার নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
অপরাহ্নে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ভবনে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রেরিত শুভেচ্ছা বার্তা পৌঁছে দেন।
বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ইশাক দার ২৩-২৪ আগস্ট ২০২৫ দুই দিনের সরকারি সফরে ঢাকায় অবস্থান করছেন।


সকালের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়, যা দুই দেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির যৌথ ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া ও অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে সহযোগিতামূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গভীর করার গুরুত্ব তুলে ধরেন।

আলোচনায় দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, সংযোগ, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ, সংস্কৃতি, পর্যটন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহ নানা খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে আন্তরিক ও গঠনমূলক মতবিনিময় করেন। বাংলাদেশ পক্ষ সকল খাতে অপ্রকাশিত সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ওপর জোর দেয় এবং এ জন্য নিয়মিত কূটনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততার গুরুত্ব উল্লেখ করে।
বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দুই দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। দুই পক্ষ ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ, সমুদ্রপথে সংযোগ উন্নয়ন ও আকাশপথে সংযোগ পুনরায় চালুর অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে।

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, পাকিস্তান “পাকিস্তান-বাংলাদেশ নলেজ করিডোর” নামে একটি নতুন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এর আওতায় আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০০টি উচ্চশিক্ষার বৃত্তি দেওয়া হবে। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ বৃত্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য নির্ধারিত থাকবে। তিনি জুলাই মাসে বাংলাদেশের গণআন্দোলনে আহত ৪০ জন শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য নাগরিকদের জন্য উন্নত চিকিৎসা, বিশেষ করে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুবিধা দেওয়ার প্রস্তুতির কথাও জানান। পাশাপাশি পাকিস্তান বাংলাদেশের হকি দলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাবও রাখে।
আলোচনায় দুই পক্ষ আশা প্রকাশ করে যে, জোরদার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়াসহ বৈশ্বিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে।
রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পক্ষ মিয়ানমারে গণহত্যার অষ্টম বার্ষিকী ও দীর্ঘমেয়াদি নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জাতিগত নির্মূলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য পাকিস্তানের অব্যাহত সমর্থন কামনা করে বাংলাদেশ।
এছাড়া, ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে দুই দেশ গাজার চলমান গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণঅনাহারের নিন্দা জানায় এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে তারা ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবি জানায় এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের সীমারেখার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়।
দুই দেশ শান্তি ও উন্নয়ন লক্ষ্যে সার্ক, ওআইসি, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বহুপাক্ষিক ফোরামে সহযোগিতা জোরদারের গুরুত্বও পুনর্ব্যক্ত করে।
বাংলাদেশ পক্ষ ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, সম্পদের বিভাজন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের জন্য প্রেরিত বৈদেশিক সহায়তা হস্তান্তর এবং পাকিস্তানে আটকাপড়া বাংলাদেশিদের প্রত্যাবাসনসহ দীর্ঘদিনের অনিষ্পন্ন ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির আহ্বান জানায়।
বৈঠক ইতিবাচক পরিবেশে সমাপ্ত হয় এবং ভবিষ্যতে আরও গভীরতর সম্পৃক্ততা ও শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টাকে ইসলামাবাদ সফরের আমন্ত্রণ জানান।




বৈঠক শেষে উভয় দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র, বাণিজ্য ও তথ্য উপদেষ্টা এবং পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী হে. এক্স. মি. জাম কামাল খান উপস্থিত ছিলেন। স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে- কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা বিলুপ্তি সংক্রান্ত একটি চুক্তি, একটি সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি, বাণিজ্য, সংবাদ সংস্থা, ফরেন সার্ভিস একাডেমি এবং থিঙ্ক ট্যাংকসমূহের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে চারটি সমঝোতা স্মারক (MoU)।